Friday, December 5, 2014

“আম্র মুকুল” আর এক জোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল

“আম্র মুকুল” আর এক জোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল

বাশার স্যার আমাদের প্রতিবেশী। আমরা ঢাকার অদূরেই রূপগঞ্জের বাসিন্দা। জন্মের পর থেকেই দেখছি বাশার স্যার সকালে উঠেই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে কিশলয় হাইস্কুলের দিকে হেটে হেটে যান মন্থর গতিতে। উনাকে কখনোই দেখা যায়নি তারাহুরা করতে। একদিন আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে আমাকে কাঁচা রাস্তা ধরে অনেক দূর যেতে হয় টেম্পো ধরতে। তারপর বাসে করে সোজা বিশ্ববিদ্যালয়। দের দুই ঘন্টার ঝক্কি। তারমধ্যে ঘুম থেকে উঠতে যদি দেরী হয় তাহলে তো কথাই নেই, ক্লাস মিস করার সম্ভাবনা একশত পার্সেন্ট। তো, সেদিন আমি সকালে নাস্তা না করে উস্কো খুস্কো চুলে কোন মতে গায়ে একটা টি-শার্ট পরে দৌরে যাচ্ছিলাম। বাশার স্যারকে লক্ষ করেও সালাম না দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। পায়ে পন্সের স্যান্ডেলটা উচূনীচু রাস্তায় অতর্কিতে দৌড়াতে গিয়ে ছিড়ে গেল। আমি তখন বাড়ি থেকে ৫ মিনিট হাটা দুরত্বে স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। স্যান্ডেল ছিড়ে যাওয়াতে আমাকে থামতেই হল। কি করব এখন? আবার বাড়িতে গেলে যেতে ৫ মিনিট, আসতে ৫ মিনিট। কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাশার স্যার সামনে এসে হাজির। বলেন, কিরে তপু সব পড়া পরীক্ষার আগের দিন পড়া যায় ভাবছিলি? না? নে আমার স্যান্ডেল নিয়ে যা। আমি বাসা থেকে আনায়ে নিব আরেক জোড়া। এই বলে আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি স্যান্ডেলটা জোর করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি কি করব বুঝতে না পেরে হঠাত স্যারকে সালাম করে স্যারের স্যান্ডেলটা পরে রওনা দিলাম। তারপরও সেদিন পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট পরে ঢুকেছিলাম ক্লাসে।


আমরা যে পাড়ায় থাকি তার চারিদিকে ফলের বাগান, কিছু অংশে বাঁশের ঝোপঝার। তখনো রূপগঞ্জের জীবন পুরোপুরি শহরের মত হয়ে ওঠেনি। তখন আমাদের পাড়ার আশেপাশের জমিগুলোতে মাটি ভরাটের কাজ চলছিল কিছু কিছু। ফলের বাগান যেখানে শেষ সেখান থেকে কৃষি জমির শুরু। ফলের বাগানের শেষ মাথায় দাড়ালে নীচু ধানী জমি দেখা যেতো। বাশার স্যার যখন হেটে স্কুলের দিকে যেতেন, দূর থেকে ছেলেমেয়েরা তাকে দেখতো, কাছে যেতো না। স্যার খুব রাগী মানুষ স্কুলে। কিন্তু আমি জানি স্যার কেমন মানুষ। বিকাল বেলা হলেই আমাদের বাড়ির কাছে মন্দিরের আশেপাশে তাকে হাটতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখেছি উনি মন্দিরের পাশের বিশাল বৃক্ষরাজির নীচে হাটতে হাটতে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন মুগ্ধ হয়ে। গাছ থেকে যখন পাতা পরতো স্যার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। আমিও স্যারের ধারে কাছে খুব একটা যাই না। দূর থেকে তার প্রকৃতি প্রেমী হৃদস্পন্দনটা যেন টের পাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বিয়ে করব, তার কিছুদিন আগে বাশার স্যারের বাড়িতে গেছি তাকে দাওয়াত দিতে। দেখি স্যার একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে উনার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। সামনে জানালা দিয়ে আমের বাগান দেখা যায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দের সাথে আমপাতার বাতাসে দোলা লাগার শনশন শব্দ ঘরময় অনুরণিত হচ্ছে। তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আমবাগানের ভিতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা দিয়ে দেখা গেল মৌয়ালেরা ফিরছে। স্যার সেদিকে একমনে চেয়েছিলেন। দরজাটা খোলা। ঘরে কেউ নেই। হাতে একটা কলম আর কাগজ দেখে বোঝা যায় স্যার কিছু একটা লিখছিলেন। পুরানো কাঠের আলমারিটার পাল্লাটা খোলা। ভিতরে কিছু কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পরে রয়েছে। আমি মৃদু স্বরে স্যারকে ডাক দিলাম, স্যার, আমি তপু। আপনি কি ব্যাস্ত? স্যার ঘার ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখলাম টেবিলের উপর কিছু দলিলপত্র রাখা। স্যার আমাকে দেখে যেই হাসি দিলেন তাতে আমার মনে হল স্যার একটা অপরূপ আমগাছ। আর তার হাসিটা আমের বোল। স্যার উঠে আমাকে বললেন, বস। আমি দেখলাম বিছানায় বসতে গেলে স্যারের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসতে হবে। স্যার আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন, আর তার সামনের চেয়ারে স্তুপ করে রাখা কাপড় আর এক বান্ডিল কাগজ সরিয়ে বিছানায় রাখলেন। অনেক লজ্জার সাথে স্যারকে বিয়ের কথা বললাম। স্যার আমাকে কিছুই বলল না। উঠে চলে গেল ভিতরের ঘরে। ফিরে এলো একটা পিরিচে একটা মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে। আমি আরো লজ্জায় পরে গেলাম। আমি স্যারের হাত থেকে পিরিচটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, একি করছেন স্যার? স্যার বলল, আরে বিয়ে করবি সেতো খুবই আনন্দের কথা। মিষ্টি খেতে হবে না? অগত্যা যখন আমি মিষ্টিটা মুখে পুরি তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি এক টুকরা লজ্জা খাচ্ছি। কথায় কথায় জানতে পারলাম বাশার স্যার তার জমিটা ডেভেলপারদের কাছে দিয়ে দিচ্ছেন। আমি শুনে খুব আহত হলাম। স্যার নিজেও মন খারাপ করে বললেন, ছেলেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে নাই। এখন প্রাইভেটে পড়তে হলে টাকা পয়সা কিছু লাগবে। আর ওরা এই এক বিঘা জমির বদলে কিছু নগদ টাকা আর উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট দিবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কত স্কোয়ার ফিট? স্যার বলল, ৮০০ স্কোয়ার ফিট। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আমি মন খারাপ করে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি স্যারের বাড়ির উঠানে একটা মা মুরগী আর তার ছানাপোনা মাটি থেকে আধার খাচ্ছে খুটে খুটে। তখন কোত্থেকে একটা ছোট বাচ্চা এসে একটা মুরগীর বাচ্চা ধরতে গেছে, আর মা মুরগীটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে লোম ফুলিয়ে ফোস ফোস শব্দ করতে করতে ছেলেটার হাতে গিয়ে একটা ঠোকর দিয়েছে। ছেলেটার বয়স তিন চার হবে। অপ্রস্তুত অবস্থায় এমন ঠোকর খেয়ে সে ঘাবরে গেছে। আমি ছুটে গিয়ে  ছোট ছেলেটাকে ধরলাম। ছেলেটা চিতকার করে কাঁদছিল। স্যার এসে বলল, এটা আমার নাতি। আমার মেয়েটার জামাই কিছুদিন আগে আরেকটা বিয়ে কইরা ফালাইছে। অনেক চেষ্টা করছিলাম তারে ফিরাইতে পারি নাই। আপাতত এখানেই আছে।

আমি ভারাক্রান্ত বুক নিয়ে ফিরে আসলাম।

বিয়ের পর অনেকদিন হল আমি ঢাকায় থাকি। একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছি। অফিস দূরে হয় বলে খিলগাতে একটা বাসা নিয়েছি। মতিঝিলে আমার অফিস। রুপগঞ্জে মা আর ছোট ভাইবোনেরা থাকে। ছুটি ছাটায় যাওয়া হয় রুপগঞ্জে। গেলে বাশার স্যারের বাসায় খুব একটা যাওয়া হয় না। রুপগঞ্জ অনেক বদলে গেছে। অনেক দখলদারের নজর এখন পূর্বাচলের দিকে। আমাদের ফলের বাগানের পাশের সেই ধানী জমিতে এখন মাটি ভরাটের কাজ চলছে। গ্রীষ্মকালে ধুলায় এদিকে হাটা যায় না। যেদিকে নজর যায় জায়গায় জায়গায় কেবল সাইন বোর্ড লাগানো। “ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক জনাব হাকিম, অথবা কোন যদু, অথবা কোন কদু, অথবা যদু-কদু-মধু সিটি”। আমার বাবাকেও প্রায়ই পীড়াপিড়ি করে প্রভাবশালী দখলদাররা। এর মধ্যে এই দখলকে কেন্দ্র করে কিছু খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটেছে। বাড়িতে প্রায়ই মাস্তানরা আসে। শুনেছি সেনাবাহিনী এর পিছনে আছে। সেনাবাহিনীর লোকেরাই এইসব জমি কিনে নেয় পরে দালালদের মধ্যমে। আমার বাপ দাদার ভিটা এখানে। আমার দুই কাকা আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকেন। বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। আমাদের প্রায় দশ বিঘার মত জমি এখানে। এর মধ্যে ৭ বিঘা জুড়ে ফলের বাগান। আমার বাবা আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক রেখেছেন এই গাছপালা দেখাশোনার জন্য। ছোটবেলা থেকেই সব ঋতুর তাজা ফল, তাজা সব্জী খেয়ে আসছি আমরা। এখনো শুক্রবারে ঢাকায় গেলে বাবা ব্যাগ ভরে ভরে সব্জী নিয়ে যান আমাদের জন্য। আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী। এই শারীরিক অবস্থায় তাজা শাক সব্জী, ফলমূল যাতে খেতে পারে তাই আমি স্ত্রীকে দুইতিন মাসের জন্য রুপগঞ্জে রেখে এসেছি। অফিস শেষে মাঝে মাঝেই রুপগঞ্জে গিয়ে থাকি। একদিন শুক্রবার সকালে দেখি বাশার স্যারের বাসার সামনে একটা ঠেলাগাড়ি। তাতে আসবাবপত্র উঠানো হচ্ছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কি চলে যাবেন? মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যা। অভাবের সংসার, জমিটা বিক্রী না করে উপায় ছিল না। আমি সেদিন সারাদিন ঘরে বসে রইলাম। বাশার স্যারের সাথে দেখা করতে যেতেও ইচ্ছা করল না। কেন যে ইচ্ছা করছিল না সে আমি জানি। ঢাকা শহর একটা রাক্ষসে পরিনত হয়েছে। তার থাবা এসে পড়েছে এই রূপগঞ্জে। এর প্রথম শিকার হলেন বাশার স্যারের মত নিরীহ মানুষ। আমি স্যারের সামনে গিয়ে স্যারকে কি বলব? স্যারকে বলার আমার কি আছে? শুনেছি তিনদিন আগে স্যারকে স্কুল থেকে বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল। স্যার নাকি বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছিলেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাকি কেউ ফ্রকে, কেউ রুমালে চোখ মুছেছিল তার কান্না দেখে।

আমি এরকম কাঁদতে পারি না। সেদিন সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিল স্যার যদি আমাকে স্যান্ডেল দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিতেন তাহলে বোধ হয় আমার ভাল লাগতো।

আমার একটা ফুটফূটে মেয়ে হয়েছে। তার নাম রেখেছি মৃত্তিকা। আমার স্ত্রীই রেখেছে। নামটা আমাদের সবারই খুব পছন্দের। আমার স্ত্রী বায়না ধরেছে মেয়ের প্রথম জন্মদিনটা রূপগঞ্জেই করবে। আমি বুধ বৃহষ্পতি ছুটি নিয়ে আয়োজন করতে রূপগঞ্জে চলে গেছি। শুক্রবারে জন্মদিনের আয়োজন। এর মধ্যে আমাকে কিশলয় স্কুলের উন্নয়ন কমিটির মেম্বার করা হয়েছে। কয়েক মাস পর পর আসি মিটিং করতে। এবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার সময় থাকতে বার বার অনুরোধ করেছে সবাই। মেয়ের জন্মদিন আর ক্রীড়া প্রতিযোগীতা পর পর হওয়ায় সুবিধাই হয়েছিল আমার। সেদিন ছিল জানুয়ারী মাসের প্রথম বুধবার। আমি স্কুলে গিয়ে জানলাম বাশার স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আমি ভাবতেই পারছিলাম না বাশার স্যারকে ছাড়া ক্রীড়া প্রতিযোগীতা কি করে সম্ভব। আমি মিটিং-এ সবাইকে রাজি করালাম যে এবার কোন এমপি, ব্যাবসায়ী, চেয়ারম্যান, কাউকেই না, এবার সভাপতি হবেন বাশার স্যার। আমার কথায় সবাই এক বাক্যেই রাজি। আমার কাঁধে দায়িত্ব পড়ল স্যারকে নিমন্ত্রণ করার। মা কে বললাম, আমাদের পুব দিকের ঘরটা গুছিয়ে রাখতে, বাশার স্যারকে নিয়ে আসব রাতে। উনি দুরাত এখানেই থাকবেন। একবারে মৃত্তিকার জন্মদিন খেয়ে যাবেন। স্কুল থেকে স্যারের ঠিকানা নিয়ে আমি উত্তরার দিকে রওনা দিলাম।

অনেক খুঁজতে হল না। রোড নম্বর বের করে বাসার নম্বর বের করে দেখি একটা কাল রঙ করা লোহার গেটের সামনে লেখা “আম্র মুকুল”। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সিড়ি এত অন্ধকার যে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি এদিক ওদিক তাকালাম খূঁজতে যে কাউকে দেখা যায় কিনা। দেখি কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি মোবাইলে ফোনের টর্চ জ্বেলে দোতলায় উঠে কলিংবেল বাজালাম। ঘরের ভিতর থেকে তেল দিয়ে কিছু একটা ভাজার গন্ধ পেলাম যেন। এক মিনিট পর দরজা খুললো একটা মেয়ে। আবছা আলোয় তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সাথে স্যারের নাতিকে দেখে বুঝলাম স্যারের মেয়ে, সন্ধ্যা । দরজা খুলেই সে ঘোমটা দিয়ে আমাকে বলল ভেতরে আসতে। আমি ভেতরে ঢুকে স্যান্ডেল খুলে ঘরের ভিতরে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। একটা খাট আর বেতের চেয়ার ছাড়া কিছুই চোখে পরল না। আমি চেয়ার থেকে বই খাতা খাটের উপর সরিয়ে রেখে চেয়ারটায় বসলাম। সন্ধ্যা ধীর পায়ে ঘরের ভিতর যেয়ে সুইচ হাতরে ৪০ ওয়াটের একটা বাতি জ্বালালো। ঘরে একটাই জানালা, খয়েরী রঙের পর্দা দেয়া। পর্দার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির বারান্দায় শুকাতে দেয়া মহিলাদের ব্রা আর আন্ডার ওয়্যার দেখা যাচ্ছে। বাতি জ্বালাতেই আমি লক্ষ করলাম সন্ধ্যার মুখটা সন্ধ্যার মতই অন্ধকার। আমি সন্ধ্যাকে বললাম, অনেকদিন স্যারের সাথে দেখা হয় না। কালকে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা। স্যারকে নিতে আসলাম। উনাকে সভাপতি করতে চাই। স্যার কি ঘুমান? সন্ধ্যা আমার দিকে কতক্ষন তাকিয়ে রইল স্থির। সন্ধ্যার ছেলেটা মায়ের আচল ধরে টানছে আর চিতকার করছে। সন্ধ্যা আঁচল ঠিক করতে রীতিমত ছেলের সাথে যুদ্ধ করছিল। আমি কিছুই বুঝলাম না কি বলব। বললাম, আপনার ছেলে কি স্কুলে যায়? সন্ধ্যা হঠাত মুখ তুলে বলল, আপনারা জানেন না? বাবা তো গত সপ্তাহে মারা গেছেন।

আমি আর যেকোন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এরকম খবরের জন্য না। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে বলল, এবাসায় আসার পর থেইকাই বাবা অসুস্থ। শুধু বলতো দম বন্ধ হইয়া আসে। সকালে হাটতে বাইর হইত আর মন খারাপ কইরা ফিরা আসতো। হার্টের প্রবলেম ধরা পরল এই বাসায় উঠার এক মাসের মধ্যেই। উনি মানসিক ভাবে ভাইঙ্গা পড়ছিল। আমরা কত বলতাম আবার পূর্বাচলে একটা বাসা ভাড়া কইরা চইলা যাইতে। কিছুতেই শুনতো না। কিসের উপর যে উনার এত অভিমান ছিল? তিন মাস পর থেকে বাবা কথা বলা বন্ধ কইরা দিল। বারান্দায় একটা গাছ লাগাইছিল, সেইটার দিকে খালি তাকাইয়া থাকতো। রোদ না পাইয়া গাছটা পরে মইরা গেসিল। তারপর থেইকা বাবা সারাদিন খালি ঐ গাছটার কথা বলতো। আমি এক ঘরে থাকতাম, আমার ভাই আরেক ঘরে। বাবা এই বসার ঘরে এই খাটেই ঘুমাইত।গত বুধবার সকালে উঠে দেখি বাবা আর ঘুম থেইকা উঠে না।
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম খাটের উপর স্যারের পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এখনো পরে আছে। খাটের নীচে স্যারের এক জোরা স্পন্সের স্যান্ডেল। নীল রঙের।  


আমি আর ঐ ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না। সন্ধ্যাকে বললাম, আমি এখন উঠবো। একটা অনুরোধ রাখবেন? স্যারের ঐ স্যান্ডেল জোড়া আমাকে দিবেন? সন্ধ্যা একটু অবাক হল। কিন্তু কথা না বলে একটা কাগজের প্যাকেট নিয়ে এসে তাতে স্যান্ডেল জোড়া ভরে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি “আম্র মুকুল” নামে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। রুপগঞ্জে ফিরে যখন আমি কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথে যাচ্ছি দূর থেকে স্যারের পুরানো বাড়ির জানালার পাশের আম গাছগুলি চোখে পড়ল। “আম্র মুকুল” নামের বাড়িটির সেই অন্ধকার ঘর কি পরিহাস না করে গেছে বাশার স্যারের সাথে। 

Wednesday, November 2, 2011

বন্ধুরা

বন্ধুরা, তোমরা সংঘবদ্ধ হও,
সোজা হয়ে দাড়াও,
আমার মৃত্যু কামনা কর,
আমি আর লিখতে পারি না বন্ধু,
আমি আর ধরতে পারি না তোমাদের হাত |

তোমরা দাড়াও,
রাস্তার পর রাস্তা ঢেকে যাক
তোমাদের ধব ধবে সাদা কাপড়ে,
সমুদ্রের ঢেউ এর মত গর্জে ওঠো বন্ধু,
মৃত্যু কামনা কর আমার |

তোমাদের ধুধু মরুভূমিতে আজ
ফুটছে না গোলাপ,
যে গোলাপ চেয়েছিলে
ঘরের বাগানে
কিংবা তোমাদের রুমালের কিনারে,
সুতার কারুকাজে |

Sunday, June 5, 2011

ömrümüzün baharı আমাদের জীবনের বসন্ত

মে মাসের তিরিশ তারিখ | ২০১১ | সেদিন আংকারা শহরে ঝির ঝির বৃষ্টি পরছে সকাল থেকে | আকাশের কোথাও মেঘ গুমোট হয়ে আছে, এই পরি এই পরি করে পুরো বৃষ্টি পরছে না | থেমে থেমে এক পশলা দুই পশলা করে ঝাপটার মত আসছে | আমাদের গাড়ি মিডেল ইস্ট টেকনিকাল ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকলো | দুই পাশে পাহাড়ি বনভূমির মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত একটা রাস্তা গিয়েছে বহুদূর | এই রাস্তা দিয়ে ঢুকলে ক্যাম্পাসের শুরু | আমি দশ বছর আগে শেষ বোধ হয় এই কাম্পাসে এসেছিলাম | দশ বছর পর আবার এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বহু স্মৃতি তরতাজা ভেসে উঠলো মনের ভিতর | আজকে আমার মনের মধ্যেও বৃষ্টি পড়ছে, আজকে আমার আকাশ ও কালো | পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি যেয়ে থামল রেকটরের অফিসের সামনে | আমি নেমে গেলাম গাড়ি থেকে |

রেক্টর বিল্ডিংএর অফিসের সামনে নোটিস বোর্ড গুলোর দিকে তাকালাম | কোনো নোটিস নেই | এখন বোধ হয় সব নোটিস ইন্টারনেটে পাওয়া যায় | মনে আছে কত
বার এই নোটিস বোর্ডের সামনে দাড়িয়েছি | পুরানো প্রিয় বন্ধুদের মুখ ভেসে উঠলো | হাসতে হাসতে গল্প করতে থাকা নিজের মুখটাকে খোজার চেষ্টা করলাম কল্পনার ভিড়ে | অস্পষ্ট দেখলামও নিজেকে | সিড়ি দিয়ে কাফেটারিয়ার দিকে হাটা শুরু করলাম | বৃষ্টি নেমে ঘাস গুলি আরো সবুজ হয়ে গেছে | গাছের পাতা গুলি আরো তাজা হয়ে আছে | আমার মনে হলো ঘাসগুলি আমাকে দেখছে, দেখছে আমার অন্তরটা | বৃষ্টির মত চোখ দিয়ে পানি চলে এলো, বুকের ভিতর অনেক মেঘ জমে আছে | জমে থাকা মেঘ গুলি একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা লাগছে যেন | সিড়ি দিয়ে নামতে থাকা এক পথিককে দেখে ব্যাগ থেকে সানগ্লাসটা বের করলাম | পথিক সিড়ি দিয়ে নেমে গেলে আমি একটু দাড়ালাম | সিড়ি দিয়ে উঠে হাতের বা দিকে ক্যাফেটারিয়া আর হাতের ডান দিকে একটা খোলা জায়গা | বসন্ত কাল আসলে রোদ পোহাতে আসে এখানে ছাত্র ছাত্রীরা | সকাল থেকে চলে আড্ডা | আজকে বন্ধ তাই কেউ নেই | কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি ১০-১২ বছর আগে বসে থাকা কপোত কপোতী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুমু খাচ্ছে | আমাদের এই ইউনিভার্সিটি তে এটা ছিল খুব দেখার মত দৃশ্য | এরকম আদর করার দৃশ্য দেখলে আমি তাকিয়ে থাকতাম | চোখ সরাতাম না | কখনই আমার কাছে অশ্লীল মনে হত না এই দৃশ্য | আমি আজকেও মনে মনে খুজলাম সেরকম অচেনা কপোত কপোতী এবং দেখলামও কল্পনায় | দেখলাম একটা ২১ বছর বয়সী মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে একটা ২১ বছর বয়সী ছেলে আর তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে মেয়েটা |

আরেকটু সামনে এগিয়ে ডান দিকে হাটা শুরু করলাম সোজা | পাথরের হাটা পথ ধরে সোজা চলে গেলাম ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টএর বিল্ডিংএর দিকে | খুব আস্তে আস্তে হাটছিলাম | অনুভব করতে চাইছিলাম অতীত | ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টএর সামনে যেয়ে দেখি ঐদিকে কোনো মানুষ নেই | সাধারণত যখন ইউনিভার্সিটি খোলা থাকে, বিল্ডিং এর সামনের জায়গা ভরে থাকে ছেলে মেয়েদের সোরগলে | চোখে ভেসে উঠলো পেলিন, ওজগে , আইচা, মেহমেত, আহমেত, এলিফ, সেলায়, মিনে ও অন্যান্য বন্ধুদের মুখ | মনে পড়ল সেই প্যালেসটাইনি যুবকের কথা যার রোমহর্সকর পালিয়ে আসার গল্প শুনে আমি হা করে তাকিয়েছিলাম | বয়স ছিল অল্প | প্যালেসটাইনি সেই ছেলেটা ছিল আমার বন্ধু | আমি ওর সাথে কত মিশেছি কিন্তু জানিনি কোনদিন যে সে একজন বিদ্রোহী |জানতাম না সে একজন ইসরাইলী সেনা গুরুতর জখম করে পালিয়ে এসেছিল | একদিন পাথরে ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতে সে যখন তার অতীতের গল্প বলছিল তখন সে আসলে আমার ভিতরে বিদ্রোহের আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল | আমি নির্যাতিত নারী শিশুর লাশ দেখতে পাচ্ছিলাম আর দেখতে পাচ্ছিলাম আমার বন্ধুটির কঠোর কব্জি উঠে গেল উপরের দিকে আঘাত করতে শত্রুসেনাকে | দম বন্ধ করে শুনেছিলাম সেই গল্প এই রাস্তায় | সামনে থেকে এই বিদ্রোহী বন্ধুটিকে না দেখলে আমি হয়ত কোনদিন বুঝতাম না জাতি হিসাবে প্যালেসটাইনিরা কি কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে | মনের ভিতর মেঘ উকি দিচ্ছিল, আবার যেন এখনি ঝরে পরবে |

ঘুরে হাটা শুরু করলাম উল্টা দিকে | যাওয়ার পথে ডান দিকে পড়ল আর্কিটেক
চার ডিপার্টমেন্ট | ডিপার্টমেন্টএর সামনে দাড়িয়ে মনে পড়ল রাশেদ ভাইয়ের কথা | ছাত্রজীবনে লাঞ্চের ব্রেক দিলেই এখানে আড্ডা জমত আমাদের | কখনো রাশেদ ভাই থাকত, কখনো থাকত মামুন ভাই | মনে আছে মাঝে মাঝে আসত পাপ্পু ভাইয়ের বন্ধু সিনান | চা খেতে খেতে গল্প করতাম কত | মনে আছে একদিন লাঞ্চ ব্রেকে বের হয়েছি ক্যাফেটারিয়ার দিকে যাব | তখন পথে দেখা হলো পাপ্পু ভাইয়ের বন্ধু সিনান আর ফাতিহর সাথে | ফাতিহর মুখ ভরা ছিল গোফ দাড়ি | আমাদের চেয়ে বয়স বেশী ছিল কিন্তু দারুন রসবোধ ছিল তার | একদিন আমাকে রাস্তায় হেটে যেতে দেখে বলে "ঋতু, আমরা শহরে যাচ্ছি, যাবে আমাদের সাথে?" আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম "বলে কি? এখন শহরে গেলে ফিরতে তো দেরী হবে | এখানে লাঞ্চ করলে হয় না ?" ফাতিহ তার স্বাভাবিক হাস্যরস মাখা কথা দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল "ঋতু, তুমি বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে পারো না, তোমার দেখা উচিত আংকারা শহর, স্কুলের ভিতর তো অনেক দেখলে |" অনেকটা জোর করে আমাকে দলমুশে (মিনিবাসে) উঠিয়ে দিল ফাতিহ | কিন্তু তারপর যেই অভিজ্ঞতা হলো সেটার জন্য আমার ফাতিহ র কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত | সিনান আর ফাতিহ মিলে আমাকে দেখালো অন্য একটা জগত যার সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না | সেদিন ওদের সাথে বের না হলে জানতে পারতাম না তুরস্কে আর্মি কি ভাবে ছাত্র আন্দোলন দমন করে | দলমুশে করে আমরা সিটি সেন্টারে পৌছালাম গল্প করতে করতে, বেশিরভাগই ফাতিহর প্রলাপ | ফাতিহ একটা একটা করে মজার গল্প বলে আর আমি আর সিনান হাসি | এই করতে করতে শহরে পৌছে আমরা রাস্তার পাশে একটা ক্যাফেতে বসলাম | খাবার অর্ডার দিলাম আমি | সিনান আর ফাতিহ অর্ডার দিল বিয়ার | তুমুল আড্ডা চলল এক ঘন্টা | বেশির ভাগই ছেলেমানুষী কথা, যার কোনো মানে নাই, যার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই | কিন্তু ফেরার সময় হলো এক ঘটনা | আমরা বাসে উঠেছি, কিন্তু বাস শহর ছেড়ে হাইওয়েতে ওঠার পথে আমাদের বাস আটকে দিল পুলিশ | আমাদের গাড়ি নিয়ে গেল পুলিশ স্টেসনে | আমি টেনসনে পরে গেলাম | এখন কি হবে | ফাতিহ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে | আমি ফাতিহ কে এত নিশ্চিন্ত দেখে বিরক্ত হলাম | সে আমার টেনসন কমানোর জন্য আমাকে বলতে লাগলো "তুমি এত চিন্তা কর কেন | পুলিশ স্টেসন কত ভালো জায়গা তুমি জান?" আমি তখন বুঝতে পারছি না আমরা পুলিশ স্টেসনে কেন | তখন সিনান আমাকে ব্যাখ্যা করলো "ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, হিজাব পরা মেয়েদের আর দাড়ি ওয়ালা ছেলেদের ইউনিভার্সিটি তে ঢোকা নিয়ে নতুন নিয়ম তৈরী করছে, সেটার প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে, এই অবস্থায় ছাত্রদের বাস পুলিশ স্টেসনে আটকে রাখা হয়েছে যাতে ভাংচুর নিয়ন্ত্রণ করা যায় |" আমি তখন আস্বস্ত হলাম | আর ফাতিহ তখন বলল "welcome to police station, great love are made in police station|" আমরা হাসতে লাগলাম | এবং যখন স্কুলে পৌছালাম তখন বুঝতে পারলাম এই শহরে একটা ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে কিন্তু স্কুলের ভিতর কেউ জানে না এই আন্দোলনের কথা | কি আশ্চর্য পদ্ধতিতে এদেশে ছাত্রদের নির্বিকার বানিয়ে রাখা হয় |

এই ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি মনে নিয়ে যখন আমি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট এর সামনে আসলাম তখন মনে পরে গেল আমার পেইন্টিং ক্লাসের
কথা | আমি দুই সেমিস্টারে দুইটা পেইন্টিং কোর্স নিয়েছিলাম | আমাদের ক্লাস হত ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টএর নিচে বেসমেন্টএ | মনে পড়ল আমি যখন পেইন্টিং ক্লাস নিতাম তখন আমার বন্ধু আইচা নিত স্কাল্পচার ক্লাস | ক্লাস করতে করতে আইচার সাথে স্কাল্পচার টিচারের প্রেম হয়ে গেল | আর এদিকে আমি আইচার নতুন বয়ফ্রেন্ড কে দেখে মুচকি মুচকি হাসতাম | মনে পড়ল আমাদের নুড স্টাডির দিন গুলি | কি ভিশন শীতের মধ্যে উলঙ্গ হয়ে একটা পুরুষ মডেল দাড়িয়ে থাকত, আর আমরা ছবি আকতাম | মনে পরে গেল আর্ট টিচারের কথা | ঘুরে ঘুরে উনি বার বার আমার ছবির সামনে আসতেন, খুব পছন্দ করতেন আমাকে | দুইটা কোর্সেই আমি এ পেয়েছিলাম | ফিজিক্সের পাশে ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট দেখে মনে পরে গেল আমি একবার ম্যাথে ফেইল করেছিলাম | প্রথম বছর লিনিয়ার আলজেবরা নিয়ে আগা মাথা কিছুই বুঝি নাই | পরে দিতিযবার যখন নিয়েছি তখন ফাইনাল পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন ছিল, যেটা কেউ পারেনি | পরে আমার শিক্ষক আমাকে ডেকে বলেছিলেন "তুমিই ক্লাসের এক মাত্র মেয়ে যে এই একটা প্রবলেম সলভ করতে পেরেছ |" আমার জীবনের একটু একটু আত্মবিশ্বাস অর্জন হয়েছে এই ইউনিভার্সিটি তে | আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম "ভাগ্গিস আমি ফেইল করেছিলাম নাহলে আজকের আমার মধ্যে কোনদিন এই আত্মবিশ্বাস তৈরী হত না |"

এই ইউনিভার্সিটি আমাকে কত কিছু দিয়েছে | কতকিছু শিখিয়েছে | লাইব্রেরির সামনে দাড়িয়ে মনে পড়ল এরকম বসন্তের একটি দিনে আমি প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম আমার নামের মানে | যখন একজন
আফ্রিকান আরবী ভাষা জানা যুবকের মুখে আমার নামের অর্থ নতুন ভাবে আবিষ্কার করি তখন আমি অবাক হয়েছিলাম| বসন্ত কালে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে বসন্ত উত্সব হয় | টার্কিশ ভাষায় বলে "বাহার সেনলিয়ি"| মনে আছে আমি বাংলাদেশের স্টল দিতাম প্রতি বছর | ছাত্র হিসাবে এই স্টল থেকে কিছু ইনকাম ও হত | দেশে থেকে অনেক টুকিটাকি জিনিস এনে দুইদিনের এই উত্সবে বিক্রি করতাম | আমাদের স্টলের পাশেই ছিল একটা আফ্রিকান স্টল | ঐখানে আফ্রিকানরা সারাদিন জোরে জোরে rap বাজিয়ে নাচানাচি করত | কখনো কখনো ওদের সাথে আমরাও নাচতাম | বাংলাদেশী স্টলে সারাদিন দাড়িয়ে থাকার কারণে সব আফ্রিকানরা আমাদের বন্ধু হয়ে যেত | একদিন একটা আফ্রিকান ছেলে এসে আমার নাম জিগ্গেস করলে আমি জবাব দিলাম "মোশাহিদা সুলতানা" | ছেলেটা আমার নাম শুনে বলে "এটা তো আরবী শব্দ, তুমি কে এটার মানে জান?" আমি বললাম "না" | সে তখন আমাকে বলল "It means the queen who can foresee " | আমি তো নামের মানে শুনে অবাক | আমি জানি মোশাহিদা মানে যে অবলোকন করে বা observe করে| আর সুলতানা মানে রানী | কিন্তু এই যুবকটি যখন দুইটা মিলিয়ে আমার নামের অর্থ দাড় করলো আমি তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম |

লাইব্রেরির সামনে একটা বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম পুরানো দিনের কথা | চোখে সানগ্লাসটা ছিলই | পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিল ছাত্র ছাত্রীরা | আজকে ছুটির দিন | একেক জায়গায় একেকধরনের ক্লাস হচ্ছে, কোথাও গান শেখার, কোথাও নাচ শেখার, কোথাও নাটক, কোথাও বাদ্যযন্ত্র | মনে পড়ল আমার বন্ধু সেলিসের সাথে দেখা করার কথা | সেলিস হাজিতেপে ইউনিভার্সিটিতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টএর শিক্ষক | সেলিস আমার এই ইউনিভার্সিটির বন্ধু না | সে আমার বস্টনের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
র বন্ধু | সেলিস সারা বছর আংকারা তে শিক্ষকতা করে আর গ্রীষ্মের ছুটিতে হার্ভার্ডে পোস্ট ডক রিসার্চ করে | সেলিসকে আমি পছন্দ করি শুধু সে আমার বন্ধু বলে নয় সেলিসের মধ্যে কয়েকটি বিষয় আমি আবিষ্কার করেছি যা আমাকে তার প্রতি প্রবল আকর্ষণ করে | সেটা হলো এত ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও সেলিস সঙ্গীত চর্চা থামায়নি | গতকাল ওর সাথে আমার কথা হয়েছে | সেলিস আজকে ইউনিভার্সিটিতে, মিউজিক ক্লাসে এসেছে | তার ক্লাস শেষ হলে আমাদের এক সাথে খাওয়ার কথা | আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠলাম |

সেলিসকে আমার সহযোদ্ধা মনে হয় কয়েকটি কারণে | তুরস্কের অনেক গুলি সৌন্দর্যের মধ্যে সেলিস একটি | আমরা যখন
নর্থইস্টার্নএ ছিলাম আমার মনে আছে আমি আমার কয়েকজন টার্কিশ বন্ধুকে ইলেকশনে দাড়াতে উদ্বুদ্ধ করি | আমাদের একটা গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য একটি সংগঠন ছিল | গ্রাজুয়েট এন্ড প্রফেসনাল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন | প্রতি বছর ছাত্রদের কাছ থেকে একটা বড় অংকের টাকা নেয়া হত ছাত্রদের কার্যক্রম অর্থায়ন করার জন্য | আমরা যখন ইলেকশনে দাড়াই তখন ওই এসোসিয়েশনের ফান্ডে ছিল প্রায় নব্বই হাজার ডলার | অথচ বছর ব্যাপী যেই কাজ হত তার বেশির ভাগ চলে যেত বিজনেস ফেকালটির নানান প্রোগ্রামে | একজিকিউটিভ কমিটিতে ৬ জনের মধ্যে ৫ জনই দেখা যেত বিজনেস ফেকালটির | প্রতিবছর যখন এই ঘটনা ঘটছিল তখন আমার মনে হলো আমাদের মত ছাত্র ছাত্রীদের এই কমিটি তে থাকা প্রয়োজন | এবং কোথা থেকে দেখি সেলিসের ও আবির্ভাব | এবং সেও মনে করে আমাদের ইলেকশনে দাড়ানো দরকার | আমি এবং সেলিস দুইজনই সেই বছর সাফল্যের সাথে নির্বাচিত হলাম | যখন আমাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল তখন আমার মনে আছে আমি মনে মনে হাসছিলাম | আজকে সেই সেলিসের সাথে আবার দেখা হবে ভেবে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো | একই ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করলেও সেলিস কে বস্টনে যাবার আগে আমি কখনো দেখি নাই | কিন্তু আজকে আমাদের দেখা হচ্ছে এরকম একটা জায়গায় যেখানে আমাদের কখনো দেখা হয়নি |

হাটতে হাটতে আমি চলে গেলাম তুর্কিশ ফোক মিউজিক ক্লাবের বিল্ডিং এ | বিল্ডিং এর কাছে যেতেই আমার মনে বসন্ত অনুভব শুরু হলো | বাশির সাথে দূর থেকে ভেসে
আসা ঢোলের শব্দে মোহিত হয়ে গেলাম | আর মনে মনে উত্তেজনা পুরানো সহযোদ্ধা সেলিস কে দেখব | যখন দেখলাম রুমের ভিতর প্রেকটিস চলছে আমি রুমের বাইরে বসে সেলিসকে মোবাইল থেকে মেসেজ পাঠালাম | বসে বসে মগ্ন হয়ে বাঁশী শুনছি | মনে পড়ল বস্টনে যখন ছিলাম তখন আমি আর সেলিস মিলে একটা তুর্কিশ ক্লাসিকাল মিউজিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছিলাম | একটা বড় হল রুম নিয়ে সেখানে ৩০ সদস্যের একটা দল যন্ত্র সংগীত পরিবেশন করেছিল | সেলিস সেখানে বাজিয়েছিল | কিন্তু আমাদের প্রোগ্রামে একটা ঝামেলা হয়েছিল | আমাদের ফিনান্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিল এক আমেরিকান মেয়ে | সে আমাদের তুর্কিশ মিউজিকের আয়োজন পছন্দ করছিল না | কারণ তারা আগ্রহী ছিল বিজনেস ফেকাল্টি ভিত্তিক রিভার ক্রুজ, নাচের পার্টি আয়োজন করতে | যখন দেখছিল সেলিস আর আমি পুরানো রেওয়াজ ভেঙ্গে নতুন ধরনের প্রোগ্রাম আয়োজন করছি তখন সেই মেয়েটি একটা চালাকি করেছিল | গানের দলের জন্য একটা সৌজন্য উপহার বাবদ মাত্র ৫০০ ডলার বাজেটে দেয়া হয়েছিল | সেই মেয়েটি সেটা এডভাইজারকে দিয়ে এপ্রুভ করায়নি | প্রোগ্রামের শেষের দিকে দেখি সেলিসের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে | এত সুন্দর একটা মানুষ, এত সুন্দর গান যে গায় তার মুখ ফ্যাকাশে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল | আমি একটু ও অপেক্ষা না করে একটা বাক্স যোগার করলাম অফিস থেকে, সেটার গায়ে কাগজ দিয়ে মুরে একটা ফুটা করে রিসেপশনে টেবিলের সামনে রেখে দিলাম | দাড়িয়ে থাকলাম বাক্সের সামনে | সেলিস এসে আমাকে জিগ্গেস করে "এটা কি?" আমি বললাম "ধরে নাও দান বাক্স | শ্রোতারা গান শুনে ফেরার পথে খুশি হয়ে যদি পরবর্তী প্রোগ্রাম আয়োজনের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য দিতে চায় তাদের জন্য এই বাক্স |" সেলিস আমার কান্ড দেখে হেসে ফেলল| পরে সবাই চলে গেলে সেলিস আর আমি বাক্স খুলে দেখি প্রায় ৪০০ ডলারের মত উঠেছে | ওই টাকাটা পরে আমরা বাদকদের দেই | সেদিন আমাদের দুইজনের এই মিলিত উদ্যোগে করা আয়োজন এবং টাকা সংগ্রহের পর থেকে সেলিস এবং আমি মনে মনে সহযোদ্ধা হয়ে গেলাম | সেদিন জেনেছিলাম আমেরিকানরা টাকা না দিলেও টাকা আমরা যোগার করতে পারি | মন থেকে কিছু করলে কোনো কাজ টাকার জন্য আটকে থাকে না | আর তুর্কিশ মিউজিক তো আরই না |
সেলিস কে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম | সেলিস আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল ওর শিক্ষকের সাথে | এবং জিগ্গেস করলো ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি ক্লাসে বসে শুনতে পারব কিনা | সেলিসের শিক্ষক এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল | আমি সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে একটা বড় ঘরে ঢুকলাম | রুমের ভিতর পর্যাপ্ত আলো | দুইপাশে গ্লাসের দেয়াল | বাইরে সবুজ গাছ দেখা যাচ্ছে | শুরু হলো এক সাথে বাশির ধ্বনি | একজন একটা ঢোল নিয়ে বসে তাল দিচ্ছে | ঢোলের শব্দটা এমন মনে হয় যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে | আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম | একসময় ক্লাস শেষ হয়ে গেলে সেলিস আলাদা করে তার শিক্ষকের সাথে বসলো | সে একটা নতুন গান নিজে কম্পোজ করে এনেছে | সেটা তার শিক্ষক কে বাজাতে দিয়ে সে নিজে ঢোল নিয়েছে | শুরু হলো গান | আমি সেলিসের সৃষ্টিশীলতা দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেলাম | মনে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে বলি প্রাউড অফ ইয়ু বন্ধু |

ক্লাস শেষ হতে হতে প্রায়
সারে তিনটা বেজে গেছে | স্মৃতিচারণ করতে করতে পেটের ভিতর কখন খিদা পেয়েছে টের পাইনি | সেলিস তার লাল জ্যাকেট পরে লাল রঙের গাড়িতে উঠলো | আমি ওর পিছে পিছে উঠলাম | সেলিসের লাল প্রীতি দেখে আমার নিজের লাল প্রীতির কথা মনে হলো | ভাবলাম দুইটা গভীর আবেগী মানুষ লাল প্রীতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর দুই প্রান্তে | সেলিস গাড়ি নিয়ে আসল ইউনিভাসিটির ভিতর চার্শিতে | চার্শি হচ্ছে মার্কেট | সেখানে একটা খাওয়ার দোকান আছে | ছাত্র অবস্থায় হাতে অনেক টাকা ছিল না বলে এখানে কখনই খেতে আসা হত না | মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দেখতাম কি কি পাওয়া যায় | তবে মনে আছে একদিন আমার জন্মদিনে আমার মা আমাকে ফোন করে বলেছিল মার কথা মনে করে কেক খেতে | আমি একদিন এখানে এসে একা একা বসে এক পিস কেক খেয়েছিলাম আর মায়ের কথা মনে করেছিলাম | আজকে মেনু দেখে সেই দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো | আমি আর সেলিস মিলে সালাদ আর চিচ্কেন অর্ডার দিলাম তারপর দুইটা ডিশ দুইজনে ভাগাভাগি করে খেলাম | তারপর আরো দুই ঘন্টা বসে রইলাম টেবিলে | আরো ৩ কাপ চা খেলাম |
সেলিস যখন বস্টনে ছিল সেলিসের হাসব্যান্ড থাকত নিউ ইয়র্কে | আমরা দেখতাম পরিশ্রমী সেলিস সারা সপ্তাহ কঠোর পড়াশুনা, গান বাজনা, আর অন্যান্য কাজ করে শুক্রবার রাতের বসে নিউ ইয়র্ক যেত | তখন থেকে দেখতাম তার সম্পর্কটা টেকানোর জন্য কি গভীর চেষ্টা | কিন্তু সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত টেকেনি | অনেক মানসিক কষ্ট নিয়ে বিয়ে টা ভেঙ্গে সেলিস এখন তরতাজা একটা মানুষ | আমরা মেয়েলি অনেক গল্প করলাম | মাঝখানে সেলিস আমাকে একদিন ইমেল করে বলেছিল আমাদের আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন করা উচিত | আমি তখন বুঝিনি এটা বলে সেলিস কি বুঝতে চাইছিল | তবে এত টুকু বুঝেছি যে আমার বন্ধু সেলিস মানসিক কষ্টে ছিল | আজকে সে যখন বলল "আমাদের দেশে পুরুষেরা চায় মেয়েরা শিক্ষিত হোক, সংস্কৃতি মনা হোক, নানান মানবিক গুনের অধিকারী হোক, কিন্তু যখন এর সব কিছু একটা মেয়ের মধ্যে পায় তখন পুরুষটি আর সেই মেয়েটি কে নিয়ে ঘর করতে পারে না | শুরু হয় দ্বন্দ | এই স্ববিরোধীতার কোনো চিকিত্সা নেই |" আমি সেলিসের কথা শুনে মাথা নীচু করে তাকিয়ে থাকলাম, বললাম "সেলিস, আমাদের দেশেও একই ঘটনা | আমাদের পুরুষেরাও তোমার মত মেয়ের সান্যিধ্য আকাংখা করে কিন্তু তারপর সম্পর্ক নিয়ে আর আগাতে পারে না |" মাথা নীচু করে পানির বোতলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলাম আমি কিছুক্ষণ | একে অপরকে বুঝতে পারার নীরবতা আমাদের মুহুর্তের জন্য গ্রাস করে নিল |

৫:৩০ এর দিকে সেলিসের এক বন্ধু আসল | সেলিস এবং এই বন্ধুটি এক সাথে লাইফ গার্ড গ্রুপে কাজ করত | স্থলে ও পানিতে বিপদে পরা মানুষদের লাইফ সাপোর্ট দেয়ার জন্য এই গ্রুপ এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়াত | সেলিস ছিল সেই দামাল মেয়েদের একজন | আমরা এক সাথে গল্প করে শেষে ঠিক করলাম আমি কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াব এখানে | এই ফাকে সেলিস তার মা আর তার
মায়ের বান্ধবীকে বাসা থেকে নিয়ে আসবে | আটটার দিকে একটা ফোক মিউজিকের কনসার্ট আছে, আমরা সেখানে যাব | সেলিস ছয়টার সময় চলে গেল গাড়ি নিয়ে | আমাকে দিয়ে গেল একটা কাগজ আর একটা কলম | সেলিস জানে আমি লেখালেখি করি | সে আমাকে বলল এই কাগজ কলম দিলাম, বসে বসে লিখ | আমি হাসলাম | আর দিয়ে গেল ওর লাল জ্যাকেট | কারণ সারাদিন বৃষ্টিতে একটু ঠান্ডা পড়েছে |

সেলিস চলে গেলে আ
মি হেটে হেটে আবার দেখতে লাগলাম পুরানো জায়গা গুলি | এই সব জায়গার প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আমার কত স্মৃতি | হাটতে হাটতে সেই জায়গায় চলে গেলাম যেখানে মাছের স্যান্ডউইচ বিক্রি করে | সেই একই গন্ধ, সেই একই জায়গা | আরেকটু হেটে সামনে গ্রোসারি স্টোর | দূর থেকে লেখা দেখা যায় "şok" | এই দোকানটা দেখলেই বোঝা যায় এর চাইতে সস্তা দোকান আংকারাতে নেই | এখানে আমার অনেক স্মৃতি | ক্লাস শেষ করে ফেরার পথে এখান থেকে কত বাজার করে ঘরে ফিরেছি | সেই দিন গুলি ফিরে আসবে না | খাবার আমাদের জীবনীশক্তি যোগায় | অল্প বয়স থেকে এই খাবারের যোগান করতে করতে স্বাবলম্বী হতে শিখেছি | আজকের আমি ১৮ বছর বয়সের আমির ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠার রূপ | এই দোকানের খাবার আমার শরীরের জীবনী শক্তি | আমি দোকানের ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দেখলাম যে আগের সেই জিনিস গুলি পাওয়া যায় কিনা | আগের সব একই আছে, শুধু প্যাকেটের রং বদলেছে, লেখা বদলেছে | চোখ যেয়ে স্থির হলো একটা চকলেটের প্যাকেটের দিকে | আমি এই চকলেটের প্যাকেট ব্যাগএ রাখতাম | দুপুর বেলা অনেক সময় ক্লাসের ফাকে ব্রেক না পেলে এই চকলেট টা খেতাম | এটা আসলে এক ধরনের wafer | আমি একটা পাচ্কেত কিনলাম | ভাবলাম দেখি না কি হয় আগের মত এটা খেয়ে আজকের রাত টা পার করে দেই |

সক থেকে বের হয়ে হেটে হেটে ইউনিভার্সিটির
পিছনের গেট দিয়ে বের হলাম | ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে বের হলে একটা বড় এলাকা জুড়ে ছাত্রদের বাসা | যারা ডর্মে থাকতে পারে না তাদের জন্য এই আবাসিক এলাকা | আমাদের সময় প্রচুর ছেলে মেয়ে এই বাসায় থাকত | এলাকার নাম ইউজইনজিল | ইউজইনজিল লেখা হয় 100. yil . এর অর্থ হচ্ছে ১০০ তম বছর | এই এলকায় আসলেই আমার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের "100 years of solitude " বইটির কথা মনে পরে | আজকেও পড়ল | গেট দিয়ে উঠে পাহাড়ি ঢালু পথটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ১০০ বছরের দশ ভাগের এক ভাগ বছরে এই এলাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে | নতুন নতুন বিল্ডিং হয়েছে, কিছু পুরানো ভাঙ্গা বিল্ডিং এখনো আছে | হাটাপথ টাতে ইট বিছানো হয়েছে | কিন্তু মেঘলা দিনে সুর্যের সেই আলোটা একই আছে | আমি ঢালু পথ ধরে নেমে গেলাম | এলাকাটা কেমন হয়েছে দেখা দরকার | নামতে নামতে এসে দেখি রবিবারের বাজার বসেছে | সেই একই জায়গায় একই বাজার | এই বাজারে এসে কত বাজার করেছি | মনে আছে টার্কিশ ভাষা যখন প্রথম শিখি তখন ভাঙ্গা ভাঙ্গা টার্কিশ ভাষায় দোকানীদের সাথে দামাদামি করতাম | কখনো এমন হয়েছে আমাকে দেখে দোকানীর মায়া লেগেছে | একটা ফুলকপি কিনলে আরেকটা ফ্রি দিয়ে দিয়েছে | আমি কত জোরাজুরি করেছি নিব না নিব না | কিন্তু আমাকে এত ছোট দেখা যেত যে আমি একা বাজারে এই ঘটনা প্রায়ই ঘটত | আমি বিব্রত বোধ করতাম | এখন মনে হয় আমি আসলেই অনেক ছোট একটা মানুষ ছিলাম, যার এত স্বাবলম্বী হবার কথা ছিল না, যার স্বাবলম্বী জীবন তার জীবনের পথ অনেক কঠিন করে দিয়েছে |

রবিবারের বাজারে পাশ দিয়ে হেটে যেয়ে আমি চলে গেলাম ফেবে অন বে
(FB 15) বিল্ডিং এর দিকে | বিল্ডিং গুলি রং করা হয়েছে নতুন করে | বাগানের বাউন্ডারী গুলিতে স্প্যানিশ গোলাপ লাগানো হয়েছে | থোকা থোকা গোলাপ ধরে আছে সবুজ গাছে | জানালা ও বারান্দা গুলিতে সেই সাদা পর্দা উড়ছে | অনেক ক্ষন হেটে মনে হলো এখন ফেরা উচিত | একটু পর আটটা বেজে যাবে | সেলিস অপেক্ষা করবে | আমি ঘুরে হাটা শুরু করলাম | আবার একটু একটু টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে | লাল জ্যাকেট টার কারণে বেচে গেলাম | আবার যখন গেট দিয়ে ঢুকলাম ঢালু পথে দেখি আমার জিন্সের প্যান্টের নীচের অংশটা ভিজে গেছে | ছাত্র জীবনে প্রতিদিন এরকম ভিজত, ছিড়ে যেত নীচের অংশ, কাদা ধুলা মেখে শুধুই হাটতাম | মাইলের পর মাইল |

ঢালু পথ দিয়ে যখন নীচে নামছি তখন মনে হলো আমার ডর্মের কাছ দিয়ে না গেলে এই যাত্রা টা অসম্পূর্ণ
থেকে যাবে | চট করে ফোর্থ ডর্ম (4 . yurt ) এর সামনে চলে আসলাম | মনে পড়ল জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম নীচের দিকে | বসন্ত কালে ডর্মের সামনের জায়গাটা ভরে যেত প্রেমিক প্রেমিকাদের কলরবে | মনে হত যেন এরা সব বসন্ত কালের পাখি | রাত পর্যন্ত গিটার বাজিয়ে গান করত ছেলে মেয়েরা মাঠে বসে | মনে পরে গেল আইচাকে | সেই ন্যাড়া মাথা কুর্দিশ বন্ধুটি আমার | একটার পর একটা সিগারেট জলত ঠোটে | ওর মাথা কাজ করত কম্পিউটারের মত | আমার যেকোনো সমস্যার সমাধান ছিল আইচার কাছে | আইচা ছিল এক মাত্র বন্ধু যে আমার চোখের পানি দেখতে পেত | আমার মন খারাপ হলে আইচার কাছে ছুটে যেতাম | সে থাকত আমার পাশের বিল্ডিং এ | আইচা এখন অস্ট্রেলিয়াতে | এত দুরে গিয়েও সে এখনো আমার খুব কাছের মানুষ |

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৮ টা বাজতে আর দশ মিনিট আছে | সেলিস ফোন করে জিগ্গেস করলো আমি কোথায় | আমি বললাম দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি | বলেই জিমনাসিয়ামের পাশ দিয়ে শর্ট কাট রাস্তাটা ধরে হাটা শুরু করলাম | জিন্সের প্যান্টের নীচের অংশটা
ভিজে একদম চুপচুপে | মেজুনলার কনগ্রেস মার্কেজিতে ঢুকলাম | আমাদের সময় এই সেন্টারটা কেবল উদ্বোধন হয়ে কয়েকটা অনুষ্ঠান হয়েছিল | এর ভিতরে খুব বেশী আসা হইনি | ভিতরে যেয়ে দেখি বড় অডিটরিয়ামের সামনে ভীর | মানুষ দাড়িয়ে আছে | আমাকে দূর থেকে দেখে সেলিস ছুটে এলো | আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা টিকেট | আমি বললাম এই ৫ লিরার টিকেট কিনা তো আমার উচিত ছিল | তুমি দিলে কেন? সেলিস বলে "মোশাহিদা, তুমি চুপ কর, যেভাবে বলি সেভাবে ঢুকে পর |" সেলিসের পিছনে পিছনে আমি ঢুকলাম | দেখি বিশাল মঞ্চ জুড়ে প্রায় ত্রিশ জনের বেশী পারফরমার বাদ্য যন্ত্র ও মাইক নিয়ে রেডি | সেলিসের মায়ের সাথে পরিচিত হলাম তার একটু পর শুরু হলা প্রোগ্রাম |

প্রথম অংশটা শুধু বাদ্যযন্ত্র | লাল, কালো আর সাদা রঙের কাপড় পড়ে বিভিন্ন বয়সী ছেলে মেয়ে, মাঝবয়সী নারী পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে | বাঁশী, ঢোল, সাচ, ভায়োলিন, ব্যবহার করে
একের পর এক মোহময়ী সব সুর একে একে আমার ইন্দ্রিয় গুলিকে শীতল করে দিল | শরীর সারাদিনের স্মৃতিচারণের যেই গভীর যন্ত্রণা গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিল তা খুব সহজে শরীরের ভিতরে মিলিয়ে গেল | স্মৃতি আর সুর এক হয়ে একটা বিমূর্ত অনুভূতি শরীরকে অবশ করে ফেলল | মন্ত্র মোহিত হয়ে যখন গান শুনছি তখন হঠাত মঞ্চের শিল্পীরা গান থামিয়ে দিল, আর ঠিক যেখানে শেষ করেছে সেখান থেকে শুরু করলো হলের দর্শকেরা | আমি পাশে তাকিয়ে দেখি সেলিস, সেলিসের মা, মায়ের বান্ধবী সবাই কোরাস গাইছে | শ্রোতাদের মুখ থেকে বের হওয়া ধ্বনি হলরুম ভরা মানুষের ভিতরের আবেগকে যেন হঠাত তাজা করে দিল | যেন তাদের ভিতরের লুকিয়ে থাকা আবেগ অনুভূতি দৃশ্যমান হয়ে ঘুরতে থাকলো পুরো হলরুম জুড়ে | আমি দেখতে পেলাম উড়ছে সেই আবেগগুলি, উড়ছে মানুষের হৃদয়ের বসন্তের স্মৃতি, উড়ছে বেচে থাকার আকাংখা, উড়ছে প্রেমাসিক্ত মানব মানবী || আমি মুগ্ধ হয়ে এই অপূর্ব পরিবেশ উপভোগ করছিলাম | আর ভাবছিলাম জীবনের কত গুলি বসন্ত কেটে গেছে | কখনো বসন্তের গভীরতাকে আপন করতে পেরেছি, ধারণ করতে পেরেছি দেহে মনে, কখনো পারিনি | কিন্তু জানি আমাদের সবার জীবনে এরকম বসন্ত আসে, সাথে আসে মোহে ভরা মানসিক জাগরণ | আমরা সেই সব বসন্তের জন্য অপেক্ষা করি যেই বসন্ত আমাদের জাগিয়ে তুলে |

বসন্ত গুলি অপূর্ণ বলে এখনো এত সুন্দর | কতবার এই অপূর্ণতা ক্লান্ত করেছে | কতবার বসন্তের এই অপূর্ণতা আবার জাগিয়েও তুলেছে দেহ মন |
মনে হলো আজকের কনসার্টটা যেন আমার জন্যেই করা | কারণ আজকের কনসার্টের নাম "ömrümüzün baharı"| এর মানে হলো "আমাদের জীবনের বসন্ত " |

সেলিস যেই গান টি গাইছে :

Aşkın odu ciğerimi
Yaka geldi, yaka gider
Garip başım bu sevdayı
Çeke geldi, çeke gider

Tak etti firak canıma
Aşık oldum cananıma
Aşk zincirin dost boynuma
Taka geldi, taka gider