Friday, December 5, 2014

“আম্র মুকুল” আর এক জোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল

“আম্র মুকুল” আর এক জোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল

বাশার স্যার আমাদের প্রতিবেশী। আমরা ঢাকার অদূরেই রূপগঞ্জের বাসিন্দা। জন্মের পর থেকেই দেখছি বাশার স্যার সকালে উঠেই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে কিশলয় হাইস্কুলের দিকে হেটে হেটে যান মন্থর গতিতে। উনাকে কখনোই দেখা যায়নি তারাহুরা করতে। একদিন আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে আমাকে কাঁচা রাস্তা ধরে অনেক দূর যেতে হয় টেম্পো ধরতে। তারপর বাসে করে সোজা বিশ্ববিদ্যালয়। দের দুই ঘন্টার ঝক্কি। তারমধ্যে ঘুম থেকে উঠতে যদি দেরী হয় তাহলে তো কথাই নেই, ক্লাস মিস করার সম্ভাবনা একশত পার্সেন্ট। তো, সেদিন আমি সকালে নাস্তা না করে উস্কো খুস্কো চুলে কোন মতে গায়ে একটা টি-শার্ট পরে দৌরে যাচ্ছিলাম। বাশার স্যারকে লক্ষ করেও সালাম না দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। পায়ে পন্সের স্যান্ডেলটা উচূনীচু রাস্তায় অতর্কিতে দৌড়াতে গিয়ে ছিড়ে গেল। আমি তখন বাড়ি থেকে ৫ মিনিট হাটা দুরত্বে স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। স্যান্ডেল ছিড়ে যাওয়াতে আমাকে থামতেই হল। কি করব এখন? আবার বাড়িতে গেলে যেতে ৫ মিনিট, আসতে ৫ মিনিট। কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাশার স্যার সামনে এসে হাজির। বলেন, কিরে তপু সব পড়া পরীক্ষার আগের দিন পড়া যায় ভাবছিলি? না? নে আমার স্যান্ডেল নিয়ে যা। আমি বাসা থেকে আনায়ে নিব আরেক জোড়া। এই বলে আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি স্যান্ডেলটা জোর করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি কি করব বুঝতে না পেরে হঠাত স্যারকে সালাম করে স্যারের স্যান্ডেলটা পরে রওনা দিলাম। তারপরও সেদিন পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট পরে ঢুকেছিলাম ক্লাসে।


আমরা যে পাড়ায় থাকি তার চারিদিকে ফলের বাগান, কিছু অংশে বাঁশের ঝোপঝার। তখনো রূপগঞ্জের জীবন পুরোপুরি শহরের মত হয়ে ওঠেনি। তখন আমাদের পাড়ার আশেপাশের জমিগুলোতে মাটি ভরাটের কাজ চলছিল কিছু কিছু। ফলের বাগান যেখানে শেষ সেখান থেকে কৃষি জমির শুরু। ফলের বাগানের শেষ মাথায় দাড়ালে নীচু ধানী জমি দেখা যেতো। বাশার স্যার যখন হেটে স্কুলের দিকে যেতেন, দূর থেকে ছেলেমেয়েরা তাকে দেখতো, কাছে যেতো না। স্যার খুব রাগী মানুষ স্কুলে। কিন্তু আমি জানি স্যার কেমন মানুষ। বিকাল বেলা হলেই আমাদের বাড়ির কাছে মন্দিরের আশেপাশে তাকে হাটতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখেছি উনি মন্দিরের পাশের বিশাল বৃক্ষরাজির নীচে হাটতে হাটতে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন মুগ্ধ হয়ে। গাছ থেকে যখন পাতা পরতো স্যার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। আমিও স্যারের ধারে কাছে খুব একটা যাই না। দূর থেকে তার প্রকৃতি প্রেমী হৃদস্পন্দনটা যেন টের পাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বিয়ে করব, তার কিছুদিন আগে বাশার স্যারের বাড়িতে গেছি তাকে দাওয়াত দিতে। দেখি স্যার একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে উনার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। সামনে জানালা দিয়ে আমের বাগান দেখা যায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দের সাথে আমপাতার বাতাসে দোলা লাগার শনশন শব্দ ঘরময় অনুরণিত হচ্ছে। তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আমবাগানের ভিতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা দিয়ে দেখা গেল মৌয়ালেরা ফিরছে। স্যার সেদিকে একমনে চেয়েছিলেন। দরজাটা খোলা। ঘরে কেউ নেই। হাতে একটা কলম আর কাগজ দেখে বোঝা যায় স্যার কিছু একটা লিখছিলেন। পুরানো কাঠের আলমারিটার পাল্লাটা খোলা। ভিতরে কিছু কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পরে রয়েছে। আমি মৃদু স্বরে স্যারকে ডাক দিলাম, স্যার, আমি তপু। আপনি কি ব্যাস্ত? স্যার ঘার ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখলাম টেবিলের উপর কিছু দলিলপত্র রাখা। স্যার আমাকে দেখে যেই হাসি দিলেন তাতে আমার মনে হল স্যার একটা অপরূপ আমগাছ। আর তার হাসিটা আমের বোল। স্যার উঠে আমাকে বললেন, বস। আমি দেখলাম বিছানায় বসতে গেলে স্যারের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসতে হবে। স্যার আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন, আর তার সামনের চেয়ারে স্তুপ করে রাখা কাপড় আর এক বান্ডিল কাগজ সরিয়ে বিছানায় রাখলেন। অনেক লজ্জার সাথে স্যারকে বিয়ের কথা বললাম। স্যার আমাকে কিছুই বলল না। উঠে চলে গেল ভিতরের ঘরে। ফিরে এলো একটা পিরিচে একটা মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে। আমি আরো লজ্জায় পরে গেলাম। আমি স্যারের হাত থেকে পিরিচটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, একি করছেন স্যার? স্যার বলল, আরে বিয়ে করবি সেতো খুবই আনন্দের কথা। মিষ্টি খেতে হবে না? অগত্যা যখন আমি মিষ্টিটা মুখে পুরি তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি এক টুকরা লজ্জা খাচ্ছি। কথায় কথায় জানতে পারলাম বাশার স্যার তার জমিটা ডেভেলপারদের কাছে দিয়ে দিচ্ছেন। আমি শুনে খুব আহত হলাম। স্যার নিজেও মন খারাপ করে বললেন, ছেলেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে নাই। এখন প্রাইভেটে পড়তে হলে টাকা পয়সা কিছু লাগবে। আর ওরা এই এক বিঘা জমির বদলে কিছু নগদ টাকা আর উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট দিবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কত স্কোয়ার ফিট? স্যার বলল, ৮০০ স্কোয়ার ফিট। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আমি মন খারাপ করে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি স্যারের বাড়ির উঠানে একটা মা মুরগী আর তার ছানাপোনা মাটি থেকে আধার খাচ্ছে খুটে খুটে। তখন কোত্থেকে একটা ছোট বাচ্চা এসে একটা মুরগীর বাচ্চা ধরতে গেছে, আর মা মুরগীটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে লোম ফুলিয়ে ফোস ফোস শব্দ করতে করতে ছেলেটার হাতে গিয়ে একটা ঠোকর দিয়েছে। ছেলেটার বয়স তিন চার হবে। অপ্রস্তুত অবস্থায় এমন ঠোকর খেয়ে সে ঘাবরে গেছে। আমি ছুটে গিয়ে  ছোট ছেলেটাকে ধরলাম। ছেলেটা চিতকার করে কাঁদছিল। স্যার এসে বলল, এটা আমার নাতি। আমার মেয়েটার জামাই কিছুদিন আগে আরেকটা বিয়ে কইরা ফালাইছে। অনেক চেষ্টা করছিলাম তারে ফিরাইতে পারি নাই। আপাতত এখানেই আছে।

আমি ভারাক্রান্ত বুক নিয়ে ফিরে আসলাম।

বিয়ের পর অনেকদিন হল আমি ঢাকায় থাকি। একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছি। অফিস দূরে হয় বলে খিলগাতে একটা বাসা নিয়েছি। মতিঝিলে আমার অফিস। রুপগঞ্জে মা আর ছোট ভাইবোনেরা থাকে। ছুটি ছাটায় যাওয়া হয় রুপগঞ্জে। গেলে বাশার স্যারের বাসায় খুব একটা যাওয়া হয় না। রুপগঞ্জ অনেক বদলে গেছে। অনেক দখলদারের নজর এখন পূর্বাচলের দিকে। আমাদের ফলের বাগানের পাশের সেই ধানী জমিতে এখন মাটি ভরাটের কাজ চলছে। গ্রীষ্মকালে ধুলায় এদিকে হাটা যায় না। যেদিকে নজর যায় জায়গায় জায়গায় কেবল সাইন বোর্ড লাগানো। “ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক জনাব হাকিম, অথবা কোন যদু, অথবা কোন কদু, অথবা যদু-কদু-মধু সিটি”। আমার বাবাকেও প্রায়ই পীড়াপিড়ি করে প্রভাবশালী দখলদাররা। এর মধ্যে এই দখলকে কেন্দ্র করে কিছু খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটেছে। বাড়িতে প্রায়ই মাস্তানরা আসে। শুনেছি সেনাবাহিনী এর পিছনে আছে। সেনাবাহিনীর লোকেরাই এইসব জমি কিনে নেয় পরে দালালদের মধ্যমে। আমার বাপ দাদার ভিটা এখানে। আমার দুই কাকা আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকেন। বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। আমাদের প্রায় দশ বিঘার মত জমি এখানে। এর মধ্যে ৭ বিঘা জুড়ে ফলের বাগান। আমার বাবা আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক রেখেছেন এই গাছপালা দেখাশোনার জন্য। ছোটবেলা থেকেই সব ঋতুর তাজা ফল, তাজা সব্জী খেয়ে আসছি আমরা। এখনো শুক্রবারে ঢাকায় গেলে বাবা ব্যাগ ভরে ভরে সব্জী নিয়ে যান আমাদের জন্য। আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী। এই শারীরিক অবস্থায় তাজা শাক সব্জী, ফলমূল যাতে খেতে পারে তাই আমি স্ত্রীকে দুইতিন মাসের জন্য রুপগঞ্জে রেখে এসেছি। অফিস শেষে মাঝে মাঝেই রুপগঞ্জে গিয়ে থাকি। একদিন শুক্রবার সকালে দেখি বাশার স্যারের বাসার সামনে একটা ঠেলাগাড়ি। তাতে আসবাবপত্র উঠানো হচ্ছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কি চলে যাবেন? মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যা। অভাবের সংসার, জমিটা বিক্রী না করে উপায় ছিল না। আমি সেদিন সারাদিন ঘরে বসে রইলাম। বাশার স্যারের সাথে দেখা করতে যেতেও ইচ্ছা করল না। কেন যে ইচ্ছা করছিল না সে আমি জানি। ঢাকা শহর একটা রাক্ষসে পরিনত হয়েছে। তার থাবা এসে পড়েছে এই রূপগঞ্জে। এর প্রথম শিকার হলেন বাশার স্যারের মত নিরীহ মানুষ। আমি স্যারের সামনে গিয়ে স্যারকে কি বলব? স্যারকে বলার আমার কি আছে? শুনেছি তিনদিন আগে স্যারকে স্কুল থেকে বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল। স্যার নাকি বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছিলেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাকি কেউ ফ্রকে, কেউ রুমালে চোখ মুছেছিল তার কান্না দেখে।

আমি এরকম কাঁদতে পারি না। সেদিন সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিল স্যার যদি আমাকে স্যান্ডেল দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিতেন তাহলে বোধ হয় আমার ভাল লাগতো।

আমার একটা ফুটফূটে মেয়ে হয়েছে। তার নাম রেখেছি মৃত্তিকা। আমার স্ত্রীই রেখেছে। নামটা আমাদের সবারই খুব পছন্দের। আমার স্ত্রী বায়না ধরেছে মেয়ের প্রথম জন্মদিনটা রূপগঞ্জেই করবে। আমি বুধ বৃহষ্পতি ছুটি নিয়ে আয়োজন করতে রূপগঞ্জে চলে গেছি। শুক্রবারে জন্মদিনের আয়োজন। এর মধ্যে আমাকে কিশলয় স্কুলের উন্নয়ন কমিটির মেম্বার করা হয়েছে। কয়েক মাস পর পর আসি মিটিং করতে। এবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার সময় থাকতে বার বার অনুরোধ করেছে সবাই। মেয়ের জন্মদিন আর ক্রীড়া প্রতিযোগীতা পর পর হওয়ায় সুবিধাই হয়েছিল আমার। সেদিন ছিল জানুয়ারী মাসের প্রথম বুধবার। আমি স্কুলে গিয়ে জানলাম বাশার স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আমি ভাবতেই পারছিলাম না বাশার স্যারকে ছাড়া ক্রীড়া প্রতিযোগীতা কি করে সম্ভব। আমি মিটিং-এ সবাইকে রাজি করালাম যে এবার কোন এমপি, ব্যাবসায়ী, চেয়ারম্যান, কাউকেই না, এবার সভাপতি হবেন বাশার স্যার। আমার কথায় সবাই এক বাক্যেই রাজি। আমার কাঁধে দায়িত্ব পড়ল স্যারকে নিমন্ত্রণ করার। মা কে বললাম, আমাদের পুব দিকের ঘরটা গুছিয়ে রাখতে, বাশার স্যারকে নিয়ে আসব রাতে। উনি দুরাত এখানেই থাকবেন। একবারে মৃত্তিকার জন্মদিন খেয়ে যাবেন। স্কুল থেকে স্যারের ঠিকানা নিয়ে আমি উত্তরার দিকে রওনা দিলাম।

অনেক খুঁজতে হল না। রোড নম্বর বের করে বাসার নম্বর বের করে দেখি একটা কাল রঙ করা লোহার গেটের সামনে লেখা “আম্র মুকুল”। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সিড়ি এত অন্ধকার যে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি এদিক ওদিক তাকালাম খূঁজতে যে কাউকে দেখা যায় কিনা। দেখি কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি মোবাইলে ফোনের টর্চ জ্বেলে দোতলায় উঠে কলিংবেল বাজালাম। ঘরের ভিতর থেকে তেল দিয়ে কিছু একটা ভাজার গন্ধ পেলাম যেন। এক মিনিট পর দরজা খুললো একটা মেয়ে। আবছা আলোয় তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সাথে স্যারের নাতিকে দেখে বুঝলাম স্যারের মেয়ে, সন্ধ্যা । দরজা খুলেই সে ঘোমটা দিয়ে আমাকে বলল ভেতরে আসতে। আমি ভেতরে ঢুকে স্যান্ডেল খুলে ঘরের ভিতরে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। একটা খাট আর বেতের চেয়ার ছাড়া কিছুই চোখে পরল না। আমি চেয়ার থেকে বই খাতা খাটের উপর সরিয়ে রেখে চেয়ারটায় বসলাম। সন্ধ্যা ধীর পায়ে ঘরের ভিতর যেয়ে সুইচ হাতরে ৪০ ওয়াটের একটা বাতি জ্বালালো। ঘরে একটাই জানালা, খয়েরী রঙের পর্দা দেয়া। পর্দার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির বারান্দায় শুকাতে দেয়া মহিলাদের ব্রা আর আন্ডার ওয়্যার দেখা যাচ্ছে। বাতি জ্বালাতেই আমি লক্ষ করলাম সন্ধ্যার মুখটা সন্ধ্যার মতই অন্ধকার। আমি সন্ধ্যাকে বললাম, অনেকদিন স্যারের সাথে দেখা হয় না। কালকে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা। স্যারকে নিতে আসলাম। উনাকে সভাপতি করতে চাই। স্যার কি ঘুমান? সন্ধ্যা আমার দিকে কতক্ষন তাকিয়ে রইল স্থির। সন্ধ্যার ছেলেটা মায়ের আচল ধরে টানছে আর চিতকার করছে। সন্ধ্যা আঁচল ঠিক করতে রীতিমত ছেলের সাথে যুদ্ধ করছিল। আমি কিছুই বুঝলাম না কি বলব। বললাম, আপনার ছেলে কি স্কুলে যায়? সন্ধ্যা হঠাত মুখ তুলে বলল, আপনারা জানেন না? বাবা তো গত সপ্তাহে মারা গেছেন।

আমি আর যেকোন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এরকম খবরের জন্য না। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে বলল, এবাসায় আসার পর থেইকাই বাবা অসুস্থ। শুধু বলতো দম বন্ধ হইয়া আসে। সকালে হাটতে বাইর হইত আর মন খারাপ কইরা ফিরা আসতো। হার্টের প্রবলেম ধরা পরল এই বাসায় উঠার এক মাসের মধ্যেই। উনি মানসিক ভাবে ভাইঙ্গা পড়ছিল। আমরা কত বলতাম আবার পূর্বাচলে একটা বাসা ভাড়া কইরা চইলা যাইতে। কিছুতেই শুনতো না। কিসের উপর যে উনার এত অভিমান ছিল? তিন মাস পর থেকে বাবা কথা বলা বন্ধ কইরা দিল। বারান্দায় একটা গাছ লাগাইছিল, সেইটার দিকে খালি তাকাইয়া থাকতো। রোদ না পাইয়া গাছটা পরে মইরা গেসিল। তারপর থেইকা বাবা সারাদিন খালি ঐ গাছটার কথা বলতো। আমি এক ঘরে থাকতাম, আমার ভাই আরেক ঘরে। বাবা এই বসার ঘরে এই খাটেই ঘুমাইত।গত বুধবার সকালে উঠে দেখি বাবা আর ঘুম থেইকা উঠে না।
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম খাটের উপর স্যারের পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এখনো পরে আছে। খাটের নীচে স্যারের এক জোরা স্পন্সের স্যান্ডেল। নীল রঙের।  


আমি আর ঐ ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না। সন্ধ্যাকে বললাম, আমি এখন উঠবো। একটা অনুরোধ রাখবেন? স্যারের ঐ স্যান্ডেল জোড়া আমাকে দিবেন? সন্ধ্যা একটু অবাক হল। কিন্তু কথা না বলে একটা কাগজের প্যাকেট নিয়ে এসে তাতে স্যান্ডেল জোড়া ভরে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি “আম্র মুকুল” নামে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। রুপগঞ্জে ফিরে যখন আমি কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথে যাচ্ছি দূর থেকে স্যারের পুরানো বাড়ির জানালার পাশের আম গাছগুলি চোখে পড়ল। “আম্র মুকুল” নামের বাড়িটির সেই অন্ধকার ঘর কি পরিহাস না করে গেছে বাশার স্যারের সাথে।